
শুভেন্দু দেবনাথ



বাগানের কুলি কামিনদের সঙ্গে অল্প কদিনেই আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আর দার্জিলিংকে আমি কখন নিজের শহর ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। যদিও আমি বাগানের বাবু গোছের লোক, কিন্তু কেন জানিনা কুলি কামিনরা আমাকে তাদের লোক বলেই ভাবত। কি জানি হয়তো ওদের সঙ্গে সহজেই ভেদাভেদ ভুলে মিশে যেতাম বলে। ওরা আমাকে ডেকে নিয়ে যায় সন্ধ্যে হলে ওদের বস্তিতে। মদ আর ওদের আন্তরিকতায় সন্ধ্যায় নাচ গানের আসর শুরু হয়। কোন দিন ওদের সঙ্গে নাচি কোনদিন শুধুই দেখি, কোন দিন রাত বাড়লে ঘরে ফিরি, আবার কোনদিন ছাং (লোকাল মদ)এর নেশায় চুর ওদের বস্তিতেই রাত কাটিয়ে দিই। মনে পড়ছে এমনি এক মাতাল দিনে যখন ক্লান্ত নারী পুরুষ এলিয়ে পড়েছে ছাং এর টানে হঠাৎই একটা নরম কিন্তু কর্কশ হাত আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক ঝুপড়ির সামনে। ঝাপসা আলোয় দেখি কুসুম। চা বাগানে পাতা তোলার কাজ করে, টি প্রসেসিং এর লেবার ইউনিটে কাজ করা নির্মলের স্ত্রী। বুঝতে পারিনি প্রথমটায়, জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করি “তোপাই কে চাহনুহুঞ্ছ (কী চাই তোর)?” খানিক আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে কুসুম। তারপর ততোধিক জড়ানো গলায় বলে “মলাই মায়া গর।” নেশায় টলোমলো আমি চমকাই, বলে কী এ মেয়ে? ওকে ভালোবাসবো? ছাং এর নেশায় শিথিল গলায় জোর আনি, “ তোপাই কে কুরা গর্দে ছন” (কি বলছিস তুই)? ঘর জান” ( ঘরে যা)। হিসহিসিয়ে হেসে ওঠে পাহাড়ি সাপ। “মেরো ঘর কাহা ছ, মেরো মনিস কোহি গর্ণ সকদৈন। ম রাত দওয়ারা রাত জ্বল ছু। হরেক দিন ওহাঁলে মাতেকো র নিদ্রামা, তর ম সুত্ন সকদৈন। ইয়হ এক ঘর ছ” (আমার ঘর কোথায়, আমার মরদ কিছু করতে পারে না। আমি রাতের পর রাত জ্বলছি, প্রতিদিন মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু আমি ঘুমোতে পারি না। এটা কি একটা ঘর)। কী বলব বুঝতে পারি না। বুঝতে পারছি বিপদ ঘনিয়ে আসছে, আমি ধীরে ধীরে গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়াচ্ছি; আমার আর পরিত্রাণ নেই। কুসুম আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ঝুপড়ির ভিতর। বেশিক্ষণ যুঝতে পারি না, আমিও ঝাঁপ দিই অতল খাদের মধ্যে। তারপর আর কিছু মনে নেই। সকালে যখন ঘুম ভাঙে, দেখি সকালের হালকা ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘার কপালে চুমু দিয়ে কাঠের ঝুপড়ির ফাঁক গলে আমার বুকের উপর আদুরে বেড়ালের মত লুটোপুটি খাচ্ছে রোদ। উঠে বসি। এক গ্লাস চা হাতে নির্মল আসে। মুখে একগাল হাসি। আমি ওর ঝুপড়িতে রাতে থেকেছি সেই কৃতজ্ঞতায়, সেই সম্মানে সে গর্বিত। কাঞ্চন ছোঁয়া রোদ ওর গাল থেকে একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে ঝরে পড়ছে। আমি মাথা তুলতে পারি না। সে চা এগিয়ে দেয় বলে, “সাব জি কুসুম তপাই লাগি চিয়া পাঠাউন”( কুসুম আপনার জন্য চা পাঠিয়েছে)। ফুটন্ত চায়ের গ্লাস হাতে ধরি কিন্তু চুমুক দিতে পারি না। একটা অপরাধবোধ কাজ করে মনের ভেতর। সামনে ফুটন্ত চা, কিন্তু সারা শরীরের ভেতর একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে যা আমার ভেতর অব্দি কাবু করে ফেলেছে। আমাকে তৈরি হয়ে আসতে বলে নির্মল রওনা দেয় বাগানের পথে। আমি বেরোলে কুসুম ঘর বন্ধ করে বাগানে যাবে। কোন রকমে চা গিলি, মুখে জল দিয়ে জামা প্যান্ট পরে রেডি হচ্ছি কুসুম ঢোকে ঘরে।
ওর সমস্ত মুখে যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার রং লেপে দিয়েছে কেউ। এতো উজ্জ্বল, এতো রঙিন ওকে আগে কখনো দেখিনি। চোখ ফেরাতে পারিনা। বুঝতে পারি ওই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আমি আবার তলিয়ে যাবো। আমি চোখ বন্ধ করে নিই। কিন্তু আমার সাধ্য কী চোখ বন্ধ করে থাকি। বন্ধ চোখেও আমি দেখতে পাই সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘার ঢেউ খেলানো গিরিচূড়া। মেঘহীন আকাশে রোদের হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকছে। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিলো। বেরিয়ে আসি নির্মলের ছাউনি থেকে। বাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলতে থাকি, আর নয়, আজ রাতে আর নয়, আর আসবো না আমি এদের বস্তিতে। কিন্তু সন্ধ্যে হবার পর থেকেই কে যেন আমার পা দুটিকে টানতে থাকে কুলি বস্তির দিকে। আমি আবার হাজির হয়ে যাই সেই গোল করা আগুন, বাটি ভরা ছাং আর মাদলের তালে তালে দুলতে থাকা গরিব মানুষগুলোর মধ্যে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বোধহয় আমি পাগল হয়ে যেতাম। কারণে অকারণে হাজির হতাম নির্মলের ঝুপড়ি ঘরে, এমনকি বাগান বন্ধের দিনেও কুসুমকে ডেকে পাঠাতাম আমার কোয়ার্টারে। কিন্তু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার উপরওয়ালার সিদ্ধান্ত। আমাকে যেতে হবে গ্যাংটক। নতুন শোরুমের তদারকিতে। সেখানে চালু করতে হবে আমাদের নতুন ব্রাঞ্চ। চলে আসার দিন কুলি কামিনরা ভিড় করে এসেছিলো আমার কোয়ার্টারে। ওদের ভিড় দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এই দেড় বছরের দার্জিলিঙের বাসে কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছিলাম ওদের সঙ্গে। ওদের সুখ-দুঃখ, অভাব-অনটনের মধ্যে আমিও যেন কীভাবে একদিন ওদের লোক হয়ে গিয়েছিলাম। তখনো জানিনা গ্যাংটকে আমার জন্য আরো এক ভয়ংকর অপেক্ষা করে আছে। যা আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি টেনে দাঁড় করাবে। এর কিছুদিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।



(ছবি গুগুল থেকে সংগৃহীত)