
পার্থপ্রতিম দাস
সুধন ও বুড়ো বটের থান
তবু একটু মকাই, একটু ধান আর মহুল। এই তো সম্বল সারা বছরের। শুয়োরের দাঁতের দাগ সুধনের বাঁ-পায়ে এখনও স্পষ্ট। সেই রাতের কথা মনে পড়ে সুধনের কখনো কখনো। ছুটে পালানোর সময় একটা বড় শুয়োরের ধাক্কায় ভেঙে পড়েছিল কাঠের মাচা। সুধন সমেত। সুধন উঠে পালাতে গিয়ে পড়েছিল আরেকটা শুয়োরের মুখে। হাতের কুড়ুলটা অন্ধকারে কোথায় ছিটকে পড়েছিল পায়নি খুঁজে। তাও শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়েছিলো সুধন। তবুও পায়ে দাঁত বসানোটা এড়াতে পারেনি। রতন মশাল আর কুড়ুল হাতে এসে বাঁচিয়েছিলো। পায়ের সেই ক্ষত শুকাতে লেগেছিলো অনেকদিন।
কুড়ুল কাঁধে অর্জুন ঝোরার জলে হাত মুখ ধুয়ে নেয় সুধন। ওই ঝোরার ধারে বেশ কয়েকবার চিতাবাঘের মুখোমুখি হয়েছে সুধন। যদিও চিতাবাঘেরা সাধারণত আক্রমণ করে না খুব ভয় না পেলে। তাও কুড়ুলের বাঁটে হাতটা শক্ত ও সাবধানি হয়ে যায় স্বভাব বশেই। বাঘ জল খেতে এসে বিরক্ত হয়ে চলে যায়। সুধনও হাঁটা দেয় নিজের রাস্তায়।
পায়ে পায়ে শিশিরের মাখামাখি। জঙ্গলও ধুয়ে দেয় সুধনের পা। সকালের নরম ভিজে আলোয় ঘুরছে প্রজাপতি, মৌমাছিরা। ফুলে ফুলে। এই বনে মধু হয় অনেক। চাক ভেঙে মধু পাড়ে সুধনরা। গারু বা মহুয়াডাঁরের হাটে মধুর দাম পায় বেশ। নিজেদেরও খাওয়া হয়।
পাখিটা তখনো ডাকছে। কী পাখি কে জানে! সুধন ঝোরা পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে ঢোকে। এখনও ঠান্ডা লাগে ভোরের দিকে। শাল ফুলের গন্ধে জঙ্গল ভরে আছে। মাটিতে ছড়িয়ে শালের ফুল। মহুল এসেছে খুব এবছর। সারাবছর খাবার অভাব হবেনা ঠিক মতো কুড়িয়ে শুকিয়ে রাখলে। তবে ওই, ভালুকের ভয়। গেলবার বিজয়ের বউয়ের গলা বুক পেট সব ফালা ফালা করে দিয়েছিলো। বউটা বাঁচেনি। প্রতিবছরই প্রায় কেউ না কেউ ভালুকের কবলে পড়ে। কেউ কেউ বেঁচে যায়। কেউ কেউ বাঁচে না…

জঙ্গলের এটাই নিয়ম। খাবার জন্য লড়তে তো হবেই। আকাশে আলো ফুটছে। সামনে দিয়ে কয়েকটা হরিণ ছুটে গেলো। সুধন রাস্তার ধারে একটা গাছের গুঁড়িতে বসে। পাশে হাতের কাছে নামিয়ে রাখে কুড়ুলটা। গাছটা দুবছর হলো ঝড়ে উল্টেছে। কিন্তু মরেনি। সুধনরাও এভাবে বাঁচে জঙ্গলের নিয়মে। উল্টে পড়লেও মরে না সহজে। এ জঙ্গলের সব গাছ, সব জল, মাটি, পথ সুধন হাতের তালুর মতো চেনে। তিনকুড়ি বয়স পেরিয়েছে অনেকদিন হলো। এখনও চামড়া টানটান। কাঠ কাটতে বা বেশি হাঁটলে, হাঁপ ধরলেও শরীর শুয়ে পড়েনি। একজোড়া বন মোরগ আর মুরগি। অনেকক্ষন থেকে ঘুরছে একটু দূরে। মোরগটা মাঝে মাঝে সুধনের দিকে তাকাচ্ছে। ঘাড় উঁচু করে। মুরগি একমনে খাবার খুঁটছে। সুধনের নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে। এই জঙ্গলেই বড় হয়েছে সে। বিন্তির সঙ্গে এমনই ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছে জঙ্গলে জঙ্গলে। ঠিক এক জোড়া মোরগ মুরগি যেন। সুধনও অমন করেই চারিদিকে নজর রাখতো। ঘাড় উঁচু করে, পেশী টান করে। হাতে কখনো এই কুড়ুল, কখনো তীরধনুক, কখনো শুধুই বাঁশের লাঠি। আর বিন্তি ছিলো অমনি কলকল। কথা বলতে বলতে একমনে মহুল কুড়াতো। কখনো পিয়েল বা হরিতকি। যদিও কেন্দ পাড়তে গাছেই উঠতে হতো সুধনকে। সে আজ অনেকদিনের কথা। বিন্তি মরেছে প্রায় সাতটা শীত পার হয়ে গেল। গ্রাম থেকে মেন রাস্তা প্রায় ন মাইল। তারপর গারুতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আরও আট মাইল। সেই মাচা বেঁধে, কাঁধে করে নিয়ে যেতে যেতে রাস্তাতেই মরে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো বিন্তি। গারু পর্যন্ত যেতে হয় নাই। একেই রাত, তারপর গোটা রাস্তা জঙ্গল। গাঁয়ে কেউ অসুস্থ হলে বেজায় বিপদ। এখনও সেই মাচা বেঁধে, আগুন জ্বেলে, টিন ধামসা বাজাতে বাজাতে, জঙ্গলের রাস্তায় কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হয় সেই মেন রাস্তা পর্যন্ত। ওখানে কোনো গাড়ি পেলে ভালো। নাহলে বাকি আট মাইল আবার। এরাস্তায় আবার হাতি বেরোয় খুব। সামনে হাতি পড়লে বিপদ সবারই।

সুধন জানে তারা এ রকম করেই বাঁচে। তাও এখন তো কতো কিছু পাল্টে গিয়েছে। ফোন হয়েছে অনেকেরই, যদিও সবসময় নাকি ফোন লাগে না। লাগলেও এই জঙ্গলের রাস্তায় কেউ গাড়ি নিয়ে আসতেই চায় না রাতবিরেতে। হাতির সামনে পড়লে বিপদ গাড়িরও। সুধন ভাবে ওর যেন এমন না হয়। ওসব শরীর খারাপ টারাপে অনেক জ্বালা। অনেক লটাপটি। তারচেয়ে, জঙ্গলে হাতি ভালুক বা শুওরের দাঁতে মরা ভালো। যা যাবে একবারে চুকে বুকে যাওয়াই ভালো। জঙ্গলে জন্ম, জঙ্গলে মানুষ, মরলেও এই জঙ্গলেই। জঙ্গলের গন্ধ মাখা শরীর সুধনের। সে শরীর জঙ্গলের গন্ধেই মিশে যাক। পেছনে খুট আওয়াজে ঘাড় ঘোরায় সুধন। একটা ময়ূর দৌড়ে পালায় ঝোপের দিকে। কে জানে এদিকে কেন আসছিলো। সুধনকে দেখে অন্য রাস্তায় দৌড় দিয়েছে। এ জঙ্গল কতো প্রাচীন সুধন জানে না। শুধু জানে এ জঙ্গল তাদের, তারা এই জঙ্গলের। জঙ্গলের ধার থেকেই যে পাহাড়টা উঠেছে আকাশ মাথায়, বাপ- ঠাকুরদার মুখে শুনেছে সেই পাহাড় থেকেই একসময় তাদের মারাংবুরু এসে অর্জুন ঝোরার নরম মাটি দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের গড়েছিলো। জঙ্গল রক্ষা করতে। পাহাড় রক্ষা করতে। সে অনেকদিন আগের কথা। সুধনরা তাই এখনও জঙ্গল পাহাড়ের রক্ষক। পাহাড়ের উপর তাদের মারাংবুরুর থান আছে। ফি বছর পলাশের সময় মেলা বসে। আশেপাশের গ্রাম থেকে সবাই আসে মেলায়। পাহাড়ের মাথা রঙে রঙে ঝলমল করে। সারাদিন চলে হাঁড়িয়া মহুলের নেশা। যুবক যুবতীদের হল্লা। ঢলাঢলি। জঙ্গলের আড়াল খোঁজে তারা। সাঙা ধরে তারা। সুধনের সেসব দিনের কথা মনে পড়ে মাঝে মাঝে। মনে মনে হাসে সুধন।


মুরগি মোরগ দুটোকে আর দেখা যাচ্ছে না। অনেক পাখি ডাকছে। সেই পাখিটার ডাক আলাদা করে আর খুঁজে পাচ্ছে না সুধন। ভোরের জঙ্গলের বাতাসে একটা শিরশিরানি ভাব থাকে। সুধন উঠে পড়ে। কাঁধে ফেলে কুড়ুলটা। হাঁটা দেয় আবার। হাঁটতে হাঁটতে সুধন কুর্চিদয়ের দিকে যায়। আগে হয়তো অনেক কুর্চি গাছ ছিলো এই দহের আশেপাশে। তাই এই নাম। এখনও জঙ্গলে এদিক সেদিক কুর্চি ফুটে থাকে অনেক। কুর্চিদয়ে হাতি আসে চান করতে। কতবার দেখেছে সুধন। শুঁড়ে শুঁড়ে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে হাতিদের চান দেখতে সুধনের খুব ভালো লাগে। অনেকক্ষণ ধরে চান করে হাতিরা। সুধন আড়াল থেকে দেখে। কখনো গাছের ডালে বসে থেকে। হাতি থাকলে সুধন অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারে। জঙ্গলই যেন ওকে বলে দেয় হাতিদের কথা। হাতির গন্ধও পায় সুধন। আরও অনেক গন্ধ পায় ও। জঙ্গলের নানান গন্ধ। এক এক কালে এক এক রকম গন্ধ। বিন্তির গায়ের গন্ধ পায় জঙ্গলে বসন্ত এলে। সে গন্ধ উদাস করে সুধনকে। জঙ্গলে তাদের নিজেদের একান্ত একটা জায়গা ছিলো। সেখানে তাদের যৌবনের অনেকটা কাটিয়েছে সুধন বিন্তি। সে জায়গায় একটা বুড়ো বটের নিচে, ঘরের মতো করেছিলো ওরা। বনের নানা জায়গা থেকে এনে অনেক ফুলের গাছ লাগিয়েছিল আশে পাশে। এখনও সেখানে ফুল ফোটে নানা জাতের। সুধন মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে বসে চুপটি করে। সে বুড়ো বট এখনও আছে। চালাটা নাই আর। গাছটা দেখলে নিজের কথা মনে হয় সুধনের। গাছের সঙ্গে সুধনের কানাকানি অনেকদিনের। সুধন এলেই বটের ঝুড়িতে ঝুড়িতে লাগে দোলা। ওর আর বিন্তির একটা দোলনাও ছিলো। বটের ঝুড়িতে ঝুড়িতে বেঁধে বানানো একটা দোলনা। তাতে লাগতো বাতাসের দোলা।



(ছবি লেখকের )