পলমহুয়া গ্রামে পৌঁছনোর আগে সদুনিয়া পাহাড়ি গ্রাম টপকে এলাম। পাহাড়ি পথ ভেঙ্গে, বাঁক নেওয়ার ঝুঁকি, টাল সামলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই পলমহুয়া। নভেম্বর মাস, বন জঙ্গল জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাতির দল। পাথরের খাঁজে খাঁজে বুনোধান মানে গণেশধান লকলকিয়ে উঠেছে। গণেশধান হাতি খুব ভালো খায়। গ্রামগুলি টপকে আসতে গিয়ে দেখে এলাম উঠোন জুড়ে কাজ চলছে। কেউ জংলি পাতা দিয়ে চাটাই তৈয়ারের কাজ করছে, কেউ তালগাছের পাতা দিয়ে ঝুড়ি বানাচ্ছে। কেউ ধান ছড়িয়ে হাতে লগি নিয়ে বসে আছে। কেউ আবার বকরি শুয়োর নিয়ে ঢালু পথ ধরে নেমে যাচ্ছে।
আমার সহচর দক্ষিণ বিহারের পরিচ্ছন্ন যুবক, নাম তার লালন ঠাকুর। নদীর নামটি সে আগেই জানিয়েছিল। দরুয়া। পাহাড়ি নদী। প্রবাহ তার পিতৃপুরুষের দিকে, অজয়ের দিকে।
পলমহুয়া গ্রামের পূর্বদিকে পাহাড় ঘেঁষে নদীটি কাঠবেড়ালির পিঠের শান্ত দাগের মতো, মাদারির হাতের খেলার মতো জড়িয়ে গেছে। আগেই জেনে এসেছিলাম, পাশের গ্রাম চন্দনায় একজন আনাজপাতির দোকানদার যে গাধার পিঠে সামান চাপিয়ে নিয়ে আসে, ভয়রো যুগলপ্রসাদ, তার দোকানের সামনে মহুয়া গাছের নিচে ক্ষণেক শ্বাস নিচ্ছিলাম, তিনি আমাকে জানালেন, এখানকার আদিবাসীরা মনে করে, দরুয়া অজয়ের বিচ্ছিন্ন ও হারিয়ে যাওয়া সন্তান। সে হাজার বছর ধরে সন্ধান করে চলেছে নিজের পিতৃদেবকে, পাহাড় টিলা পার হয়ে তার গতি তাই কখনো অশান্ত আবার কখনো শান্ত। এখানকার অনেক ছোটো ছোটো নদী কেউ অজয়ের পত্নী কেউ বা কন্যা আবার কেউ পুত্র। আসলে দরুয়া পাহাড়ি মেঘ ধোঁয়াশা বৃষ্টির ও ঝর্ণার সন্তান। বর্ষাকালে সে দুরন্ত হলেও নিজের চলার পথ থেকে সামান্য সরে গেলেও গ্রামের আঙ্গিনা ও উঠোনে প্রবেশ করে না। শীতকালে অনেকটা কাকচক্ষুর মতো বিমর্ষ।
পলমহুয়াকে দেখে প্রথমে একটি পরিত্যক্ত গ্রাম মনে হয়েছিল। মুণ্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের গ্রাম। দরুয়ার পাশে, কাঠকুটো শুকনো ডাল পাতা দিয়ে, গোলাকার ঝুপড়ি, ঝুপড়ির সামনে উঠোন। কেউ কোথাও নেই যেন, এমনকি টিলার ঢালু ধরে নেমে যাওয়া পথের ওপরে কেউ নেই। জনচিহ্নহীন গ্রাম, শুধু বাতাস শির শির, কোথাও কাঠকুটো পুড়ে যাওয়া গন্ধ। উঠোনের মধ্যিখানে কাঁচা আমের আঁটি, শুকনো শালপাতার ডোঙ্গা, ছাগল শুয়োরের নাদি। উঠোনে গাছের ডালের সাহায্য নিয়ে, কুটির গড়ে তোলা হয়েছে। আর বৃক্ষগুলিকে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেন কুটিরেরই অংশ।
গাছের ডালে শুয়োর ছাগল ও শিয়ালের চামড়া ঝোলানো আছে। লালন ঠাকুর জানালো, এই দিকটা গ্রামের প্রায় শেষ সীমানা। এখানকার গ্রামগুলির নিয়ম হল, সীমানার শেষে কুটির গড়ে তোলা হয়। যাতে জংলি জানোয়ার ও বুনো ফলের সহজেই নাগাল পাওয়া যায়।