
সৌগত ভট্টাচার্য
বড় রাস্তার উপর এক বিরাট তিনতলা দালান বাড়ি থেকে চৌকা সাদা মোটর গাড়িতে চড়ে বার হত ধরম প্রসাদ। মোটর গাড়িটা মোড়ল পাড়া ভাটার দিকে আসত শনিবার করে। ফকির মাটি কোপাতে কোপাতে পুকুরের পাড়ের গায়ে কোদালটাকে ঠেকনা দিয়ে, মাটি ভর্তি হাত কপালে দিয়ে আলো আড়াল করে ওই দূরের পিচ রাস্তার দিকে হাঁ করে তাকায় থাকত ধরমের জন্য। ফাঁকা রাস্তার থেকে চোখ সারায় আবার হাতে থু দিয়ে হাত ঘষে কোদাল হাতে নিত। ধরমের মোটর গাড়ির ভাটায় ঢুকলে প্যাঁ প্যাঁ করে হর্ন বাজাতো। ভাটির আগুনের মত পশ্চিমের আকাশটা লাল হলে সন্ধ্যা নামত পুকুরের জলে। ফকিরের চোখে জল থেকে আলো লাগত, ভাটির মত। দিনের শেষ আলোত দেখে ফকির ঠাহর করত, জল থেকে ডাঙায় ওঠার সময় হইছে। ফকির ল্যাঙ্গট করে পরা ভিজা ভিজা গামছাটা ছেড়ে ধুতিটাকে কোমরের বান দিত। শনিবার হাজিরার দিন, ধরম প্রসাদ টাকা বিলাবে।
ধরম চওড়া পাড়ের কোঁচানো ধুতি, গিলা করা পাঞ্জাবি গলায় সোনার হার হাতে রুপার পানের ডিবা নিয়ে গাড়ি থেকে নামত। এইদিক ওইদিক দেখতে দেখতে পিছে হাত দিয়ে পায়ে পায়ে ভাটার অফিসের দিকে আগায় যেত ধরম। ধরমের চটির রং ফকিরের পায়ের আঙুলের হাজার মতোই ধবধবা সাদা। কাঞ্চনগুড়ি শহরের কিনারে একমাত্র ইটভাটার মালিক ছিল ধরম প্রাসাদ। বিহারের ঠাকুরগঞ্জ ধরমের দেশ। ঠাকুরগঞ্জ থেকে কাঞ্চনগুড়ি এসে নিজের নামে ইটভাটা তৈরি করছিল ধরম প্রসাদ। ঠাকুরগঞ্জ এলাকার ইটের খুব নাম এই রাজ্যে, ভাটার সংখ্যা অনেক। হিসাব বুঝেই কাঞ্চনগুড়িতে ইটের ব্যবসায় নামছিল ধরম। উত্তরের জেলা সদর কাঞ্চনগুড়িতে তখন চুন সুরকি জমানা শেষ। অনেক চা বাগানের হেড অফিস কাঞ্চনগুড়িতে। তখন চা বাগানের অফিস সদরে সরকারি অফিস স্কুল কলেজ নিয়ে শহর তৈরি হচ্ছে গোটা উত্তর জুড়ে। বাবুলোকরা কাঠের বাড়ি টিনের চালের বদলে পাকা বাড়ি বানাচ্ছে। শহরে দালান তৈরির ইট জোগান দিতে ভাটা খুলছিল ধরম।
কাঞ্চনগুড়ি থেকে সাড়ে তিন মাইল দক্ষিণে মোড়ল পাড়া। আরো আগালে শাপলাবাড়ি, পাশেই বাংলাদেশ বর্ডার। ফকির ফি বছর শাপলাবাড়ি যায়, মুর্শিদের মেলায়। মেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় ফকির বাসের কন্ডাক্টরকে বারবার বলে ইটভাটায় নামাতে। মোড়ল পাড়ার বাস স্টপের নাম ইটভাটা হয়ে যায় বাস চড়া মানুষের মুখে। ইটভাটা চালুর পর ভাটার গায়ে লাগা জমিনের অনেক মানুষ হালকৃষি ছেড়ে ধরমের ইটভাটায় কাজে যেত। ফকিরের চেনা অনেক মানুষ শহরে যায় রাজমিস্ত্রির লেবার হয়ে কাজে করতে। বাড়ি বানানোর মিস্তিরিরা আসে ধরমের দেশ বিহার থেকে। বিহারের মিস্তিরি আর মোড়ল পাড়া, শাপলাবাড়ির লেবাররা ধরমের ভাটার ইট দিয়ে চৌকা শহর কাঞ্চনগুড়ি তৈরি করতে শুরু করে। ধরম মোড়ল পাড়ার মানুষদের ইট ছাঁচে ফেলা ইট পুড়ানোর কাজ শেখায়, ভাটায় কাজে লাগায়। বিহারের ইটভাটা লেবারের মুজুরি বেশি, লোকাল লেবার সস্তা। কাঞ্চনগুড়ির লোকাল ভাটার ডিপি ইট ছিল বিহার দিনাজপুরের ইটের চেয়ে সস্তা। সস্তা ইট বেশি পছন্দ ছিল কাঞ্চনগুড়ির খরিদ্দারদের। গরুর গাড়ি করে ইট যেত শহরে, পরে ট্রাকে সাপ্লাই হত গুনতি হিসাবে। ফকিরের চোখে এখনো ইট ভর্তি গাড়ির চৌকা ডালা ভাসে। এই ভাটার পয়লা দিন থেকে ফকির ছিল মাটি কাটার লেবার। হাজিরা পাওয়ার শনিবার করে ফকির দূর থেকে দেখত মালিক ধরম প্রসাদকে। ধরম একটা চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা ডিবার থেকে বার করে থেঁতা করা পান মুখে দিত, আর পিক ফেলাতো। গুনে গুনে টাকা হাতে দিত ম্যানেজার বাবু। হাজিরার টাকা কোমরে গুঁজে ফকির অফিস ঘরের মেঝেতে একটা পেন্নাম ঠুকত নিয়ম করে। পাশে সরে এসে আরেকটা পেন্নাম করত দূরে বসে থাকা ধরম প্রসাদকে।
মোট কয়টা পুকুর আছে ফকিরচাঁদ একমাত্র জানে। পুকুরগুলাকে ফকির নাম ধরে ডাকে। অনেক নাম ফকিরেরই দেওয়া। আঙুলে কড় গুনতে পারে না ফকির। দুই হাতে আঁটে না পুকুরের গুনতি। এককাল হয়ে গেল চিমনির ধোঁয়া দেখা যায় না ফকিরের বাড়ি থেকে। অনেকবার ডিপির ইটভাটা বিক্রির কথা হলেও এই জমিন বিক্রি হয় নাই। ধরম প্রসাদ ইটভাটা দেখায় ব্যাংক লোন নিয়ে অন্য ব্যবসায় টাকা খাটায়, পরে শোধ করতে পারে নাই। বন্ধ ভাটার আকাশে পাখিরা উড়তে শান্তি পায়। আগে চিমনির ধোঁয়ায় পাখি আসত না। ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে কুচা কয়লার ছাই উড়ত। এখন শ্রাবণের জল ভরা কালা ছাই মেঘ ওড়ে ভাটার আকাশে।
শ্রাবণ মাসে পুকুরগুলা উপচায় যায়। পুকুরের জলে কালা মেঘ, পাখি, গাছের ছায়া পড়ে। ফকির মাঝে মাঝেই পুকুরের জলের ছায়ায় কাঞ্চনগুড়ি শহরের ছবি ভাসতে দেখে। যে শহরে ফকির রাজ মিস্তিরির লেবার হয়ে কাজে যায় নাই কোনো দিন। শুধু প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে রাজাবাড়ির মেলায় যায়। জলের ছায়ায় কাঞ্চনগুড়ির বাড়ি দোকান ঘর দালান স্কুল অফিস দেখে ফকির। শহরের ছায়ার ভিতর কোনো পাখি মাছ গাছ শ্যাওলা দেখা যায়না। জলের ছায়ায় শহরের সব বাড়ি, বাড়ি জনলা দরজা ছাদ রাস্তা ঘাট উঠোন সব ইটের মত চৌকা লাগে ফকিরের। লোকে বলে, এই শহরের সব পাকা বাড়ির ইটের বুকে ধরম প্রসাদের নাম খোদাই করা আছে! ডিপি ছাপ ইট! ইট পুড়লে একটা চারকোনা শহর হয়ে যায়। ফকির মনে মনে কাঞ্চনগুড়ির নাম দেয় ‘ধরম নগর’। কাঞ্চনগুড়ির মালিকই ফকিরের মালিক ধরম প্রাসাদ।
সন্ধ্যার আগে ছোভার হাটের দিকে আকাশ লাল হলে পাখিরা ভাটার গাছগুলোতে ফেরে। কাইকিচিরে ভরে যায় ভাটার বাতাস। হাইটেনশন লাইনের ফোকর দিয়ে ইট রঙের সূর্য ডোবে। সূর্যটাকে ফকিরের আধলা ঝামা ইটের মত দেখতে লাগে। সূর্যের গায়ে ধরমের নাম লেখা থাকে না। ফকিরের পিঠের চামড়ায় গেরুয়া সূর্য পড়লে পিঠটা চকচক করে। তিন কুড়ি পাঁচ হলেও ফকির পুরা ভাটার মাঠ চক্কর দেয় সারাদিন। শ্রাবণের রোদে ঘাম চুয়ায় ঘাড় দিয়ে। ফকির ভিজা আল থেকে একটা জিগার ডাল তুলে হাতে নেয়। গোখরাটা তাল পুকুরের কোনায় বাচ্চা দিছে। এই গোখরা কেউটা নিয়েই সামনের শ্রাবণ মাসে মনসা পূজায় বিষহরি পালা হবে কাঞ্চনগুড়ির রাজাবাড়িতে! চিমনির মাথায় চিলগুলা ঘাপটি মেরে রাত কাটায়। ব্যাঙের ডাক শুনে ফকির মেঘের দিকে তাকায়। শ্রাবণের রাতে বৃষ্টি হলে পুকুরের কানা উপচায় আল আর জল হয়ে এক হয়ে যাবে। বন্ধ ইট ভাটার কাদা জলের রং গেরুয়া ঠেকে ফকিরের। বর্ষার জলে মাঠটা সমুদ্র হয়ে গেলে আকাশের ছায়া পড়ে জলে।
বর্ষাকালে গোটা কাঞ্চনগুড়ি শহরটা স্যাঁতস্যাঁতা শ্যাওলায় ঢেকে যায়। বৃষ্টি হলে শহরের বাড়ির ইটগুলো জল পায়। বৃষ্টির মিঠা জল শুষলে নোনা ধরে দেওয়ালে, পলেস্তারায়। শহরের লোকে থার্ড ক্লাস ডিপির ইটকে গালি দেয়। ফকির একেকটা পুকুর কাটলে সেই মাটি দিয়ে সদরের একটা গোটা এলাকার দালান বাড়ি তৈরি হত, ফকিরের সোজা হিসাব। মহকুমা অফিস সদর স্কুলের বাড়ি ওই পশ্চিমের পুকুরের মাটি কাটা ইটে তৈরি হয়েছিল। জমিন হাঁ হয়ে জল বার হলে একটা পাড়া তৈরি হত ডিপি ছাপের ইটে। শহরে ইটের মত চৌকোনা বাড়ি থেকে সূর্য ডোবা দেখা যায় না! ওই উত্তরের তাল গাছের সামনের পুকুরে ফকির ফাতনা পাতে। পাশে কলার ডোঙায় কাঠি গোঁজা। ফাতনার দিকে তাকায় বসে থাকে ফকির। ফকিরকে মশা ধরে। পুকুরের জলে কোর্টের নতুন বানানো দালানের লাল ছায়া ভেসে ওঠে। ফকির ছিপে টান লাগাতে ভুলে যায়। বোল্লার চার মাছ ঠুকরায় গিলে যায়। ফকির যত পুকুর কাটত শহর পোয়াতির মত ফুলে ওঠতে থাকে। ফকির কালিতলার পাশের পুকুরের জলে সদরের ল্যান্ড অফিসের ছায়া ভাসতে দেখে। ওখানে জমির পর্চার কাগজ আছে ফকিরের। জলের ছায়ায় অফিস গুলাতে অনেক মানুষের ভিড় দেখতে পায় ফকির। সদরে ভিড় দেখে শ্যাওলার মত নির্জন ফকিরের ভয় করে!
ফকির পশ্চিমের পুকুরে ধরম প্রসাদের হলুদ বাড়িটার ছায়া ভাসতে দেখে। পশ্চিম পুকুরের কাটা মাটি দিয়ে তৈরি ইটে ধরমের বাড়ি তৈরি হয়েছিল। এই পশ্চিমের পুকুরটাকে ফকির খুব ভক্তি করে। ওই পুকুরের জলে চান করতে নামে না, জাল ফেলে না, ফাতনা ডোবায় না ফকির। পাখি বসলে হুস হুস করে তাড়ায় ফকির। রোজ সন্ধ্যায় ভাটার মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার সময় এই পুকুরটাকে পেন্নাম ঠোকে। সন্ধ্যার সিনেমা হলের ছায়া পড়ে ক্যানেলের ধারের পুকুরে। এই পুকুরের মাটি দিয়ে “রূপছায়া” সিনেমা হলের ইট সাপ্লাই হয়। সন্ধ্যার সিনেমা হল জমজমাট হলে ভাটা মানুষহীন হয়। ফকিরের বাড়ির ছায়া ইটভাটার কোনো পুকুরের জলে পড়ে না। ফকিরের বাড়ি ইটের তৈরি না। শুধু ইটের বাড়ির ছায়াই ভাসে পুকুরের জলে।