
সৌপ্তিক চক্রবর্তী
রামমোহন দুরুদুরু বুকে পায়চারি করতে থাকে স্কুলের সামনে। দুপুর বলে লোকজন কম। ভালোই হয়েছে। একটু পর নিশ্চয়ই পারুল পুজোর ভোগ খেয়ে বাড়ি ফিরবে। সেই সুযোগটাই নিতে হবে তাকে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে রামমোহন স্কুলের উল্টোদিকে ল্যাম্পপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। উফ! সময় যেন কাটছেই না। সে ঘন ঘন আঙুল মটকাতে থাকে। চিঠিটা ঠিক মতো দিয়ে উঠতে পারবে তো? পারুল চিঠিটা নেবে তো? পড়বে তো? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে থাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আপনা থেকেই পকেটে হাত চলে যায়। না, চিঠিটা ঠিকই আছে।
লনের একদম পেছন দিকে এক বিশাল ডায়াসের ওপর নবদম্পতির সিংহাসন। রামমোহন পাশ কাটিয়ে সেদিকে এগোয়। ডায়াসের কাছাকাছি গিয়ে মামাকে দেখে। মামাও দেখেছে তাকে। ‘এসেছিস? আয়, আয় বলে ডায়াসে নিয়ে উঠে পল্টুর কাছে গিয়ে বলে ‘এই দ্যাখ মোহনদা এসেছে। পল্টু দামি ব্লেজার পরে সেজেগুজে নতুন বউকে পাশে নিয়ে বন্ধুদের সাথে গ্রুফি তোলায় ব্যস্ত। বাবার কথায় একবার হালকা রামমোহনকে দেখে নিয়ে আলগা হেসে ‘ভালো তো বলে আবার ছবি তোলায় মেতে যায়। এদিকে ‘ও জগুদা, একটু শুনুন তো বলে কে যেন একটা তার মামাকেও ডেকে নিয়ে চলে যায়। রামমোহন বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে। তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই পল্টুরা দাঁত কেলিয়ে দামি মোবাইলে ছবি তুলতে থাকে। আর সেগুলোই ‘দেখি দেখি করে দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে খিল্লি করতে থাকে। রামমোহন বেশ অপমানিত বোধ করে। নতুন বউয়ের সাথে তাকে পরিচয় করানোর প্রয়োজনই বোধ করে না পল্টু! সে কি এতটাই ফ্যালনা নাকি। এর মধ্যে স্যুট-টাই পরা একজন হোমরা চোমরা গোছের লোক ডায়াসের দিকে এগিয়ে আসে আর তাকে দেখেই পল্টু ছবি তোলা ছেড়ে ‘এসো এসো, রবিদা বলে বিগলিত হয়ে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। এই ফাঁকে রামমোহন খুব চেষ্টা করে একটু হাসি ফুটিয়ে নতুন বউয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে ‘আমি পল্টুর পিসতুতো দাদা বলে গিফটের প্যাকেটটা হাতে গুঁজে দিয়ে নেমে আসে ডায়াস থেকে। গটমট করে গেটের দিকে এগোয়। উর্দিপরা ওয়েটার আবার আসে কাবাবের ট্রে নিয়ে। মুখোমুখি পড়ে গেলেও রামমোহন কাবাব নেয় না। পাশ কাটিয়ে সোজা গেটের বাইরে বেরিয়ে আসে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটা বাস পায়। বাসের পেছনের সিটে বসে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার প্রথমে খুব দুঃখ হয়। এতটা অপমানিত হবে ভাবলে সে আসতই না। বেকার চুল-দাড়ি ছাঁটানো হল। কাচা পাঞ্জাবিটা বের করে পরা হল। এতটা রাস্তা আসা হল। বাড়িতে রান্নাও নেই কিছু। তারপর তার দুঃখটা বদলে গেল রাগে। পল্টুটা মানুষকে সামান্য সম্মানটুকু দিতে জানে না। হতে পারে সে বড়লোক। বিদেশে থাকে। না হয় রামমোহন তেমন কেউ নয়। কিন্তু সে তো অপোগণ্ডও নয়। বরং নিজের সামান্য ক্ষমতায় যেটুকু পারে সেটুকু করে সৎভাবে রোজগার করে। শুধু হ্যাংলার মত গিলতেও সে যায়নি। মামা নেমন্তন্ন করেছিল তাই সৌজন্য রাখতেই গিয়েছিল। অসভ্য কোথাকার! মনে মনে রামমোহন এইসব বলতে থাকে।